ফরিদুল মোস্তফা খান, কক্সবাজার থেকে::
সৈকতে সার্ফ বোর্ড নিয়ে খেলতো একটি ছেলে। কিন্তু এটি যে সার্ফ বোর্ড সেটি তার জানা ছিলো না। সৈকতে নামার জন্য একসময় পুলিশ তার কাছ থেকে চাঁদা নিতো। একদিন টাকা না থাকায় পুলিশ তাকে থানায় ধরেও নিয়ে যায়। এরপর স্কুলের ফি পুলিশকে দিয়ে ছাড়া পেলেও, সার্ফিং নেশা তার মাথা থেকে যায়নি। ২০০১ সালে বিদেশিরা এসে সেই ছেলেকে আবিষ্কার করলেন বাংলাদেশের প্রথম সার্ফার হিসেবে। সার্ফিংয়ে তার অদম্য আগ্রহ দেখে তাকে নেওয়া হলো ইন্দোনেশিয়ার বালিতে। এরপর হাওয়াইতে গিয়ে হাজারো সার্ফারদের পেছনে ফেলে প্রতিযোগিতায় সামনের আসন ছিনিয়ে আনেন। সেই জাফর আলমের হাত ধরেই বাংলাদেশে সার্ফিংয়ের যাত্রা শুরু। এখন সার্ফিংকে বাংলাদেশে বিদেশি পর্যটক নিয়ে আসার অন্যতম একটি মাধ্যম হিসেবে ধরা হচ্ছে। তার শখ, নেশা আর স্বপ্নের সার্ফিংয়ে এগিয়ে যেতে শুরু করেছে বাংলাদেশ। কক্সবাজারকে একটি সার্ফিং সিটি হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেন। পুরো আলাপজুড়েই তার শুরু, এগিয়ে চলা, সংগ্রাম, স্বপ্নসহ নানা বিষয় প্রাধান্য পায়। শুরুতেই জানালেন, বিবিসিসহ অনেকগুলো সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে এর আগে কথা বলেছেন তিনি। কিন্তু অনেক কথা এখনও কেউ জানে না। সেসব বলা-না বলা কথার মধ্য দিয়ে শোনালেন তার গল্প, কক্সবাজার সৈকতের পাশ দিয়ে সার্ফ বোর্ড নিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন এক অস্ট্রেলিয়ান সার্ফার। তখন ১৯৯৫ সাল। সার্ফ বোর্ড দেখে খুব অদ্ভুত লেগেছিলো জাফর আলমের কাছে। জাফর সৈকতের পাশের বাসিন্দা। পিছু নেন ওই অস্ট্রেলিয়ানের। অস্ট্রেলিয়ান ওই নাগরিক জাফর আলমের আগ্রহ দেখে কিছু একটা বুঝতে পারলেন। কিন্তু তাদের দু’জনের ভাব বিনিময়ের জন্য ভাষার মিল নেই। কেউ কাউকে কিছু বলতে পারছেন না। কিন্তু বুঝতে পারছেন ঠিকই। অস্ট্রেলিয়ান বুঝলেন, ছেলেটি সার্ফ বোর্ড দেখে পিছু নিয়েছে। আর জাফর আলম বুঝলেন, অস্ট্রেলিয়ান সার্ফ বোর্ডটি দিতে পারেন টাকার বিনিময়ে। তখন ওই অস্ট্রেলিয়ানের কিছু বাংলা টাকার দরকার ছিলো। সৈকতের পাশে হালকা ভেজা বালুর উপর লিখলেন ‘২০০০ টাকা’। এতেই বুঝে গেলেন অস্ট্রেলিয়ান। মায়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে এসে জাফর আলম কিনে ফেললেন সেই সার্ফ বোর্ড। কিন্তু এই বোর্ডের কাজ কী, কী হয় এই বোর্ড দিয়ে অথবা এটি দিয়ে কেমন করে খেলা যায়- তার কিছুই জানা ছিলো না তার। গল্প এগোয়, বোর্ড দিয়ে সৈকতে খেলতে থাকেন তরুণ জাফর আলম। সৈকতের ঢেউয়ে বোর্ড নিয়ে ভাসতে থাকলেন। তিনি লক্ষ্য করলেন, ঢেউ এলেও সার্ফ বোর্ড ধরে ভেসে থাকা যায় আর ঢেউয়ের মধ্যে টানলে এটার গতি আরও বাড়ে। কিন্তু এর আর কোনো কৌশল তার জানা নেই। কেউ ঢেউয়ে এটা নিয়ে খেলেছে, এমনটি কোথাও দেখেননি। এভাবে ১৯৯৫ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত চার বছর সার্ফিং বোর্ড নিয়ে খেলতে থাকেন জাফর।
‘১৯৯৮ সালে একদিন একটি স্পোর্টস টিভি চ্যানেলে দেখলাম, আমার বোর্ডের মতোই কিছু একটা নিয়ে খেলা হচ্ছে। এই প্রথম আমার সার্ফিং দেখা। কিন্তু তখনও আমি জানতাম না, এর নাম সার্ফিং। ওই বছর একদিন আমেরিকা থেকে ‘সার্ফিং দ্য নেশন’ নামে একটি চ্যারিটি সার্ফ দল কক্সাবাজারে আসে। দূরবীন দিয়ে তারা যখন সৈকতের সৌন্দর্য্য দেখছিলো তখন হঠাৎ চোখে পড়ে, দূরের শৈবাল বিচে একটি ছেলে সার্ফিং করছে। তখন তারা দ্রুত ছুটে এসে আমার সার্ফিং দেখে।’
১ তখনই সার্ফিং দ্য নেশনের টিম লিডার টম বাওয়ার আমাকে সার্ফিংয়ের নিয়মকানুন শিখিয়ে দেন। যাওয়ার সময় টম একটি বিজনেস কার্ড দিয়ে যান আর বলে যান, ‘ইউ আর দ্য ফার্স্ট সার্ফার ইন বাংলাদেশ। দিস ইজ সার্ফ বোর্ড, যোগ করেন জাফর। তিনি বলে চলেন, সেসময় টম বাওয়ারের দেওয়া বিজনেস কার্ডটি বাসার মধ্যে হারিয়ে ফেলি। এর তিনবছর পর হঠাৎ বাসা পরিষ্কারের সময় আবার কার্ডটি খুঁজে পাই। এরপর টম বাওয়ারকে ইমেইল করি, ‘হাই টম! আই নিড গাম’। অর্থাৎ, বোর্ডের সঙ্গে পা লাগিয়ে রাখার যে মোম লাগে, একে আমি ‘গাম’ মনে করে এটি দরকার জানিয়ে ইমেইল করি। তখন টম ফিরতি ইমেইলে বলেন, ‘আই ইনভাইট ইউ টু বালি।’ অর্থাৎ তিনি আমাকে বালিতে সার্ফিং প্রতিযোগিতায় আমন্ত্রণ জানান। কিন্তু তখন জাফর আলমের পাসপোর্ট ছিলো না। ঢাকাও কোনোদিন যাওয়া হয়নি। এজন্য টম বাওয়ার ওয়েস্টার্ন ইউনিয়নের মাধ্যমে তাকে এক হাজার ডলার পাঠিয়ে দেন ভিসা ফি ও টিকিট করার জন্য। টাকা পাওয়ার পর ওই রাতেই ঢাকা চলে আসেন সার্ফার জাফর আলম। গাড়ি থেকে নামেন সায়েদাবাদে। সেই প্রথমবারই তার ঢাকায় আসা। সায়েদাবাদ নেমেই তিনি আকাশের দিকে তাকান কোনো বিমান উড়ছে কিনা তা দেখার জন্য। কারণ, তিনি মনে করতেন, ঢাকায় গিয়েই চলে যাবেন ইন্দোনেশিয়া। ২ শহরের পিচ ধরে হাঁটতে থাকেন সৈকতের ছেলে জাফর আলম। হাঁটতে হাঁটতে সোনারগাঁও হোটেল পৌঁছান তিনি। সেখানে বিমানের টিকিট করার জন্য খোঁজ নেন। কাউন্টারের একজন তাকে বলেন, আগে পাসপোর্ট লাগবে। তখন তিনি জানতেনও না কোথায় ও কীভাবে পাসপোর্ট করতে হয়। এরপর লোকের কাছে জিজ্ঞেস করে করে তিনি পাসপোর্ট-ভিসা-ফ্লাইটের টিকিটও করে ফেলেন। অ্যাম্বেসিতে নানা বিড়ম্বনা- ইংরেজি জানেন না, শেষে টম বাওয়ারের কার্ডটি দেখিয়ে পার পেলেন। কিন্তু এয়ারপোর্ট কোথায় এটাও তার জানা ছিলো না। এবার কাওরান বাজার থেকে হেঁটে হেঁটে এয়ারপোর্টের সামনে চলে আসেন জাফর আলম। দেখতে পান, লোকজন ব্যাগ-লাগেজ নিয়ে ভেতরের দিকে যাচ্ছে। তখন আবার আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখেন, কোনো প্লেন উড়ছে কিনা। একটু ভেতরে ঢুকতে চাইলে তাকে বলা হয়, রাত ১টায় ফ্লাইট, এখন এসেছেন কেন! জাফর বলেন, এরপর ইমিগ্রেশন আমার কাছে টাকা দাবি করে। টাকা নেই বলায় আমাকে ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়। আসলে তখন পকেটে নাস্তা করার মতোও কোনো টাকা ছিলো না। বাইরে বসে কাঁদছি আর মনে মনে ভাবছি, টম বাওয়ার হয়তো ভাববে, আমি টিকিট-ভিসা না করে টাকাগুলো খেয়ে ফেলেছি! ‘এরপর বুদ্ধি করে কার্ডফোন থেকে কক্সবাজারে একজনকে ফোন করে এয়ারপোর্টে পরিচিত একজনকে খুঁজে বের করি। তার সহযোগিতায় এয়ারপোর্টের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে শেষ পর্যন্ত ইমিগ্রেশন পার হই। আমার কাছে তখন খাওয়ার মতো কোনো টাকা নেই। ওই ফ্লাইটে চড়ে খালি পেটে পৌঁছাই ইন্দোনেশিয়ায়।’ এয়ারপোর্টে নেমেই টম বাওয়ারকে দেখতে পান তিনি। এরপর টম বাওয়ার তাকে বালিতে নিয়ে যান। সেখানে হাজার হাজার সার্ফাররা জড়ো হয়েছেন। তিনি একা আট বছর সার্ফিং করেছেন কিন্তু এতো সার্ফার একসঙ্গে সেবারই প্রথম দেখলেন।
৩ এসব দেখে উদ্দীপ্ত হন জাফর আলম। দেশে ফিরে গঠন করেন সার্ফিং ক্লাব। স্থানীয় ছেলেমেয়েদের সার্ফিংয়ে নিয়ে আসার চেষ্টা করেন। তার প্রথম ছাত্র ছিলেন জুনায়েদ, এরপর আসেন সোহাগ। সেই ক্লাবে এখন প্রায় ৭০ জন সার্ফার রয়েছেন। এরপরের তার সব অর্জনের কাহিনি সবার জানা। ২০১৫ সালে বিয়ে করেছেন ব্রিটিশ নাগরিক অ্যানিকে। অ্যানি একজন এনজিও কর্মী ও ধাত্রী পেশায় নিয়োজিত। কক্সবাজারে ‘শিশুর জন্মের সময় মায়ের মৃত্যুরোধ’ নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা রয়েছে অ্যানির। বর্তমানে এ দম্পতি যুক্তরাজ্যে থাকছেন। তবে একেবারে চলে যাননি, ফিরবেন কক্সবাজারে। আর না ফিরে পারবেন কী করে! সার্ফিং আর কক্সবাজার নিয়ে যে অনেক স্বপ্ন তার।
শোনান সেসব স্বপ্নের কথাও, ইংল্যান্ডে সার্ফিং করতে গিয়ে দেখলাম, পানি খুব ঠাণ্ডা আর নিচে ধারালো পাথর আছে। আবার অস্ট্রেলিয়ায় পানির নিচে আছে হাঙর। কিন্তু কক্সবাজারে হাঙরও নেই, পাথরও নেই। বিশ্বের বহু দেশের সমুদ্র সৈকতে সার্ফিং করার অভিজ্ঞতা রয়েছে তার। বাংলাদেশে সার্ফিংয়ের মাধ্যমে বহু বিদেশি আগমনের সম্ভাবনা দেখছেন তিনি। বিদেশিরাও বলছেন, বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার সবচেয়ে উত্তম সার্ফিং ডেস্টিনেশন। ‘অস্ট্রোলিয়া, ইংল্যান্ড ও আমেরিকায় সার্ফিংটা ছড়িয়ে গেছে। এখন বিদেশি সার্ফাররা বাংলাদেশ সম্পর্কে জেনে কক্সাবাজার সৈকতে আসতে শুরু করেছে। তবে সরকার এখনও ঠিকমতো উদ্যোগ নেয়নি। বলা যায়, চেষ্টা চলছে। রেললাইন ও এয়ারপোর্ট হয়ে গেলে অনেক বিদেশি সার্ফার সহজে কক্সাবজার পৌঁছে সার্ফিং করতে পারবে।’ তিনি আরও বলেন, জাপান-আমেরিকায় যারা সার্ফিং শিখতে চায় তারা এখানে আসতে পারে। কোনোকিছু শেখার আগে ট্রেনিং দরকার হয়। আর সার্ফিংয়ের সেই ট্রেনিং গ্রাউন্ড হচ্ছে কক্সবাজার। কক্সবাজারকে সার্ফিং সিটি হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। এটাই আমার স্বপ্ন। ৪ সার্ফিংকে বাংলাদেশে জনপ্রিয় করতে বিভিন্ন উদ্যোগ নিতে আগ্রহী বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনও। করপোরেশনের ন্যাশনাল হোটেল ট্যুরিজম ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ পারভেজ আহমেদ চৌধুরী নিজে সার্ফিং পছন্দ করেন। কক্সবাজার সৈকতে যারা সার্ফিং করছেন তাদের সঙ্গে তার নিয়মিত যোগাযোগ। তার সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, পৃষ্টপোষকতা এই মুহূর্তে দরকার। সার্ফিং বাংলাদেশে অনেক বিদেশি নিয়ে আসতে পারে। তিনটি বিষয় কক্সবাজারকে ‘লার্নার সার্ফিং ডেস্টিনেশনে’ পরিণত করবে। একটি হলো, পানির নিচে পাথর না থাকা; দ্বিতীয় হলো, চোরাবালি নেই এবং তৃতীয়, সামুদ্রিক রাক্ষসী প্রাণীর থাবা নেই। আর কক্সবাজারের ছোট ছোট ঢেউ হওয়ার ফলে সার্ফিং যারা শিখতে চান তাদের জন্য সবচেয়ে ভালো সুযোগ।
পাঠকের মতামত